“সভ্যতার অসুখ”- উচ্চরক্তচাপ


                 সভ্যতার অসুখউচ্চরক্তচাপ 


মানব সভ্যতা এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে এবং আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবন কে পুঁজি করে কিছু রোগ-ব্যাধিও আমাদের জীবনের সাথে মিশে যাচ্ছেসভ্যতা যেমন আমাদের দিয়েছে নতুন নতুন সুখ আস্বাদনের আশীর্বাদ, তেমনি দিয়েছে নতুন অসুখের অভিশাপ। হয়ত, এসবই সভ্যতার টিকে থাকার নিজস্ব কোন রহস্য 
সভ্যতার বয়ে নিয়ে আসা সেই সব অসুখের বিস্তারিত একটি একটি করে সবার কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করব এই লেখার মাধ্যমে

আজ প্রথম কিস্তিতে থাকবে উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশনবর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশেও এমন একটি পরিবার খুজে পাওয়া কঠিন হবে যেই পরিবারের কোন সদস্য এই সভ্যতার মরনব্যাধিতে ভুগসেন নাউচ্চ রক্তচাপ প্রায়ই একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত এর জন্য চিকিত্সা প্রতিরোধ দুটিই জরুরি তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাত্ মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে

উচ্চরক্তচাপ কি?
একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ মি.মি মার্কারী বয়সভেদে এই রক্তচাপ বাড়তে পারে বা কমতে পারে কারো রক্তচাপ সব সময়ের জন্য যদি বেশি মাত্রায় থাকে (যেমন-১৩০/৯০ বা ১৪০/৯০ বা তারও বেশি) যা তার দৈনন্দিন কাজ বা স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যাহত করে, তখনই এই অবস্থাটিকে আমরা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলি


New guideline of High blood pressure



প্রধানত উচ্চরক্তচাপ কে দুইভাবে ভাগ করা হয়ঃ
প্রাইমারী/এসেনসিয়াল উচ্চরক্তচাপ
সেকেন্ডারি উচ্চরক্তচাপ  

কেন হয়?
প্রাইমারী/এসেনসিয়াল উচ্চরক্তচাপের ৯৫% এরও বেশি ক্ষেত্রে কোন কারন খুজে পাওয়া যায়না তারপরেও বিজ্ঞানীরা কিছু কারন চিহিত করেছেন যেমন-
জেনেটিক কারণ-ফ্যামিলিয়া উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে (মানে বাবা-মায়ের আছে বাচ্চারও হতে পারে), পরিবেশগত কারন(অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, অনিয়ন্ত্রিত ওজন, ধূমপান, এলকোহল পান), অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ডায়াবেটিসে ইনসুলিনের অকার্যকারিতা

সেকেন্ডারি উচ্চরক্তচাপের ক্ষেত্রে(নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে)প্রধানকারণগুলো হল- স্থুলতা, মদ্যপান, কিডনির বিভিন্ন অসুখে, হৃৎপিন্ডের মহাধমনীর কোন একটি জায়গা সঙ্কুচিত থাকলে, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার ও অন্য অসুখ, কিছু ওষুধ(স্টেরয়েড, জন্মবিরতিকরন পিল, ব্যথা নিরামক), গর্ভাবস্থা জনিত উচ্চরক্তচাপ  ইত্যাদি
                                 

কাদের হতে পারে?
৪০-৪৫ বত্সর বয়স পর্যন্ত পুরুষের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি নারীর চেয়ে বেশি তবে পঁয়তাল্লিশোর্ধ বয়সে নারী-পুরুষ উভয়েরই উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা বাড়তে থাকে ডায়াবেটিস থাকলে বা পরিবারের অন্যদের উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়
কিভাবে বুঝবেন(উপসর্গ)?
-সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মাথাব্যথা
-ঘাড় ব্যথা                           
-চোখে দেখতে অসুবিধা হওয়া বা চোখে ঝাপসা দেখা
-রাতে ঘুমাতে না পারা
-সব সময় খিটখিটে মেজাজ থাকা

চিকিৎসা কি জরুরী?
উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এজন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন, মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কী? ধারণা সম্পূর্ণ ভুল কোনোক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরেও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না কারও কারও ধারণা, একবার ওষুুধ খেলে তা আর বন্ধ করা যাবে না
আবার কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে, উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না বা প্রয়োজন মনে করেন না মনে করেন ভালোই তো আছি, ওষুধের কী দরকার? ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল ধরনের রোগীরাই হঠাত্ হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে তাদের অবশ্যই ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে, নিয়মিত ওষুধ সেবনসহ রুটিন চেকআপ করাতে হবে


কি চিকিৎসা করবেন?
উচ্চ রক্তচাপ এর চিকিৎসা দুইভাবে করা যায় একটি ওষুধ ছাড়া অন্যটি ওষুধ দিয়ে
ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা:  যাদের হাইপারটেনশনের মাত্রা খুব বেশি নয় কিংবা অল্প কিছুদিন হয় সমস্যা দেখা দিয়েছে তাদের পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়
ওষুধ সহ চিকিৎসা:
উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দিয়ে করা হয়। যেমন- ডাইইউরেটিক্স, বিটাবুকার, এসিই ইনহিবিটর, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, ভ্যাসোডাইলেটর জাতীয় ওষুধ। ১টি ওষুধ দিয়ে এর প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। প্রয়োজনবোধে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ধীরে ধীরে ডোজ বাড়ানো বা কমানো অথবা নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।



যদি দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করেন, কি হবে?
() স্ট্রোকঃ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ
() হার্ট ফেইলিওর
() হার্ট অ্যাটাক, মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন
() কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়া
(চ) চোখের রেটিনা নষ্ট হয়
(ছ) মারাত্মক উচ্চরক্তচাপে উন্নীত হওয়া

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণঃ কিভাবে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি কমাবেন?   

Ø     জীবনধারার পরিবর্তনঃ
-দুশ্চিন্তা পরিহার করা।
-অতিরিক্ত ওজন কমানো। শরীরের ওজন অতিরিক্ত হলে ধীরে ধীরে তা কমানো উচিত। এজন্য উচিত নিয়মিত হাঁটা এবং পরিশ্রম করা। অনেকেই ওজন কমানোর জন্য তাড়াহুড়ো করেন এটা কিছুতেই ঠিক নয়।
-পরিমাণ মতো খাওয়াঃ খাবার পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করা উচিত। অতিরিক্ত লবণ বা লবণ জাতীয় খাবার পরিহার করা উচিত। ফাস্টফুড বা ফ্রোজেন ফুড-এ লবণের পরিমাণ বেশি থাকে। প্রাণীজ প্রোটিন ত্যাগ করে শাক-সবজি, সালাদের দিকে ঝোঁকা ভাল।
-ধূমপান, এলকোহল পরিত্যাগ করা উচিত।
-প্রাথমিক অবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে উপরের নিয়ম মানলে অনেকের রক্তচাপ - মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসেযদি এরপরও স্বাভাবিক না হয় তবে ওষুধের সাহায্য নিতে হয়


                       


Ø     সতর্কতা :
-
চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে প্রত্যেকেরই উচিত নির্দিষ্ট সময় পর পর রক্তচাপ পরীক্ষা করা
-হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ রাখা বা অনিয়মিতভাবে ওষুধ গ্রহণ না করা
-ওষুধ গ্রহণ অবস্থায়ও অন্তত প্রতিমাসে একবার রক্তচাপ পরীক্ষা করা
-একজন বিশেষজ্ঞের অধীনে থাকা এবং পরামর্শ অনুযায়ী চলা
-আলগা লবণ, ফাস্টফুড, ফ্রোজেন ফুড খাওয়ায় সতর্ক থাকা
-যেহেতু রোগে দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয় কাজেই বছরে অন্তত একবার কিডনি এবং হার্টের পরীক্ষা অথবা শারীরিক সকল পরীক্ষা চেকআপ করানো উচিত

বাংলাদেশে পূর্ণবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছরের উপরের জনসংখ্যার ১৫-২০% উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বিশ্বে এ হার ২৫-৩০%। বিশ্বের প্রায় ১.১ বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে এবং এদের মধ্যে প্রায় ৭.১ মিলিয়ন প্রতিবছর উচ্চ রক্তচাপজনিত বিভিন্ন জটিলতায় মারা যাচ্ছে। কাজেই বয়স বাড়ার সাথে সাথে সতর্ক হোন,
উচ্চ রক্তচাপকে না বলুন।


             [নিয়ন্ত্রিত জীবন, সুন্দর ভবিষ্যৎ]

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Autonomous Sensory Zones of Peripheral Nerves

আমাদের সন্তানরা তাদের স্কুল লাইফেই তাদের পিতা কে হারাবে